লিখেছেনঃ Zeeshan
ভবিষ্যতের কোনো এক দিন। পৃথিবী এখন সবুজ গাছপালায় ভরপুর।বায়ুতে দূষণের মাত্রা এখন শূন্যের কাছাকাছি। এই অপরূপ পরিবেশের মধ্যে একটি আমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাঙা বাড়ি । হঠাৎ কটমট শব্দ করে বাড়িটার আন্ডার গ্রাউন্ডের দরজাটি খুলে গেল। সেই দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে কম্পিত পায়ে হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে উপরে উঠে এলেন মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম । চুলগুলো পেঁকে গেছে অনেক আগেই । কিন্তু যখন তিনি মাটির নিচের এই বদ্ধ জগতে প্রবেশ করেছিলেন তখনও তিনি ছিলেন আঠার বছরের একজন যুবক। এখন তার বয়স কত তা তিনি নিজেই জানেন না। এতগুলো বছরে পুরো পৃথিবীর দৃশ্যই পাল্টে গেছে। তিনি যেই বাড়ির নিচে ছিলেন তার আশেপাশেও অনেকগুলো বাড়ি ছিল, কিন্তু এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অতীতের কথা মনে পড়ে যায় তার, বাঙ্কারের ভেতর থাকা অবস্থায় তিনি সব সময় ভাবতেন কখন এই দুঃসময়ের ইতি ঘটবে। তিনি নিজের জীবদ্দশায় এর শেষ দেখে যেতে পারবেন কিনা । কিন্তু যতই দিন যায় তার আশা ক্ষীণ হতে থাকে। একসময় তার মনে হতে শুরু করে এই ভাইরাস দুর্দমনীয়।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই দুর্ভাগ্যের শুরু হয় ২০২০ সালে । তখন ২০১৯ সালের শেষের দিকে জন্ম নেওয়া covid-19 নামের একটি ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করলেও ততদিনে ভাইরাসটি কেড়ে নেয় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। জীবাস্ত্র যে কী পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে গোটা বিশ্ব তখন তা প্রত্যক্ষ করে। এটি যে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও বেশি কার্যকরী সকলেই তা নিশ্চুপে স্বীকার করে নেয় । কারণ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয় সকলের প্রকাশ্যে কিন্তু জীবাস্ত্র থাকে সাধারণ দৃষ্টি সীমার বাইরে। কে কার উপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। সেই কারণেই covid-19 ভাইরাস হতে পরিত্রাণ লাভের পর পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতাধর দেশ জীবাস্ত্র তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করে । জন্ম হয় নানান ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পন্ন ভাইরাসের । এক দেশ আরেক দেশের উপর শুরু করে জীবাস্ত্র প্রয়োগ । প্রতি উত্তরে সেই দেশও শুরু করে নিজের সন্দেহের মধ্যে থাকা বাকী দেশগুলোর উপর জীবাস্ত্র প্রয়োগ । এইসব জীবাস্ত্রের মধ্যে কিছু থাকে এত বেশি শক্তিশালী যে এক একটা জনপদ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত। এই সকল ইতিহাস আব্দুল কাইয়ুম বইয়ে পড়েছেন । তার জন্ম আরও পরে হয়েছে । কিন্তু তিনি স্বচক্ষে যে ভাইরাসটির তান্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেন সেটি হলো hdmv-60 ভাইরাস । মানব জাতি যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারল ততদিনে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে । ব্রাজিলের একটি গোপন গবেষণাগারের পাশেই ভূমিকম্পের ফলে গবেষণাগারের বিল্ডিংয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় । আর এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে গবেষণাধীণ hdmv-60 নামের ভাইরাসটি । ভাইরাসটি স্পর্শ অথবা অন্য যেকোনো মাধ্যমেই একজন পোষকের দেহ হতে অন্য একজন পোষকের দেহে ছড়িয়ে পড়ত। গবেষকরা বহু বছর গবেষণা করেও এর প্রতিষেধক আবিষ্কারে ব্যর্থ হন, কারণ ভাইরাসটির মিউটেশন ক্ষমতা অন্য যে কোন ভাইরাস হতে অন্তত দশগুণ বেশি। ফলে একে একে ধ্বংস হতে থাকে বহু জনপদ । না খেতে পেয়েও মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয় বহু মানুষ ।
দিন যত যায় খাদ্যের মজুদও শেষ হয়ে আসতে থাকে । সেই সাথে পাণের উপযোগী পানির অভাব তো আছেই । যার কারণে শুরু হয় এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের খাদ্য আর পানি নিয়ে যুদ্ধ । ভাইরাস আর যুদ্ধের প্রকোপে পৃথিবীর বুক থেকে মানব জাতিরই বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। এইসব কাইয়ুম সাহেবের চোখে দেখা । তার বাবা ছিলেন আর্মির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । সেই সৌভাগ্যের কারণে কাইয়ুম সাহেবের পরিবারের জায়গা হয় সুরক্ষিত এই বাঙ্কারে। তাদের সঙ্গে আরও কিছু পরিবারও এখানে ছিল । কিন্তু যাদের
ভাগ্য এমন সুপ্রশস্ত ছিল না তারা কেউ বেঁচে নেই ।
হয় যুদ্ধের কারণে নয়তো ভাইরাসের আক্রমণে তারা সকলেই মারা গেছে । এখন মাইলের পর মাইল হাঁটলেও একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । তবে মৃত মানুষের কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া তেমন কঠিন কাজ না।
ভাইরাসটির ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে । তা প্রায় ৬ মাস আগের ঘটনা । ঐদিন আব্দুল কাইয়ুম সাহেব মাটির উপরে এসে বহু বছর আগের পুরনো সোলার প্যানেলটাকে ঠিক করছিলেন এমন সময় পূর্ব দিক থেকে একটা চার চাকার রোবট ভনভন শব্দ করতে করতে তার কাছে এগিয়ে আসে । রোবটটাকে প্রথমে দেখে তিনি অবাক হন। রোবটটা তার কাছে এসেই নিজের গায়ে এটাচ করা স্ক্রিনে একটা ভিডিও প্লে করে । ভিডিওতে একজন লোক কথা বলছেন:
"আমি ড. ওয়ালিউল্লাহ । আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে আছি। যদি কোন ব্যক্তি এই ভিডিওটি দেখে থাকেন তবে তার জন্য একটি সুসংবাদ দিতে চাই । আমি hdmv-60 ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছি। এই ভ্যাকসিন আমি নিজের দেহে প্রয়োগ করেছি। সুফলও পেয়েছি । কিন্তু দুঃখের কথা হলো এটি ব্যবহার করার জন্য আমার এখানে কেউ আর বেঁচে নেই । অনেক খুঁজেও এই ভ্যাকসিন ব্যবহার করার জন্য কোন মানুষ পাইনি। তাই আমি আমার তিনটি রোবটকে ভ্যাকসিন সহ তিন দিকে পাঠাচ্ছি। যদি কেউ পেয়ে থাকেন নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারেন ।" এখানেই ভিডিওটি শেষ হয়ে যায় । কাইয়ুম সাহেব ভ্যাকসিনটা নিজের শরীরে প্রয়োগ করেছেন । তারপর বাকি ভ্যাকসিন সহ রোবটটাকে পাঠিয়ে দেন অন্য কারো খোঁজে । রোবটটাকে পাঠানোর সময় তার পিঠে এখানকার ঠিকানাও লিখে দেন যাতে কোন মানুষ তা খুঁজে পেলে এখানে আসতে পারে । কে জানে, এটা আর কাউকে খুঁজে পাবে কিনা । তবুও আজকের মত প্রতিদিনই রাস্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন । যদি কেউ রোবটটাকে পেয়ে তার কাছে আসতে চায় সেই ভরসায় । অনেক সময় হয়ে গেছে এবার ভেতরে যাওয়া উচিত । তা ছাড়া ভেতরের সবজি গাছগুলোতেও ত পানি দিতে হবে । যুদ্ধের সময় যাতে বাঙ্কারের ভেতরে মজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে যাতে বাইরে যেতে না হয় সে জন্য কৃত্রিম পরিবেশে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে। ওইসব খাবার খেয়েইত এতদিন ধরে বেঁচে আছেন । ভেতরের রুমে যেয়ে দেখেন রাহাত, ফাহাদ আর সাদিয়া একসঙ্গে গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে ।রাহাত আর ফাহাদের বয়স সতেরো বছর । সাদিয়া তাদের এক বছরের ছোট । এই তিনজন ছাড়াও কাইয়ুম সাহেবের সাথে এখানে থাকে নাহিদ, স্নিগ্ধা , তনিমা আর তৃষা। নাহিদের বয়স চোদ্দ বছর, স্নিগ্ধার বয়স সাড়ে ষোল বছর। তনিমা ও তৃষা দুজনে জমজ বোন । তাদের বয়স পনেরো বছর । যদিও এটা তাদের আনুমানিক বয়স। দিন তারিখ গণনার কোন উপায় তো কাইয়ুম সাহেবের কাছে ছিল না। তার সঙ্গে বাকি যারা এখানে ছিলেন তাদের কেউ বেঁচে না থাকলেও তারা নিজেদের বংশধর রেখে গেছেন । এখন এরাই হলো তার পরিবার । এদেরকে নিয়েই এই সুন্দর পৃথিবীতে মানব সভ্যতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন । পূর্ববর্তীদের তুলনায় এরা পৃথিবীকে আরো সুন্দর ভাবে শাসন করবে বলেই তার বিশ্বাস । বর্তমানে কত খ্রিস্টাব্দ তা কাইয়ুম সাহেবের জানা নেই, কিন্তু তিনি এই কথাটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে মানব সভ্যতা পুনর্বিকাশের এটাই হচ্ছে প্রথম বর্ষ ।